"প্রণাম করি এই শূন্য রাত্রিকেবন্দনা করি দিবালোক
প্রণাম করি জীব জন্তু জানোয়ারমানুষ ও ভাগাড়ের কৃমিদের
যা রাখে তপ্ত মাটির রক্তযেসব রিপুক্ষমাঅবিদ্যার
আলো ও আঁধারের শ্মশানপ্রিয় নারীআঁজলা ভরা মধু কিংবা বিষ


প্রণাম করি শস্যবিদ্ধ মাটি আরপাহাড় জলরেখা বহমান
ভূত ও অধিভূত রহস্য কাম বীজব্যোম ও বিজ্ঞান আশীর্ষ
বন্দনা করি শত্রু ও মিত্রকেশীতল ও উষ্ণ স্নায়ুর তাপ
করুণ ও অকরুণ তরঙ্গধৌত সৌরঝড়জৈব রসায়ন


প্রণাম করি আলম্ব ইতিহাসযুদ্ধ,জরায়ু ও উন্মেষ
ভ্রম ও সচেতন সঞ্চরণশীল ধ্বংসঅপরূপ নির্মাণ
ত্যাগ ও রতিসুখ কিংবদন্তী ও মৌল সঙ্গীতশব্দদ্রুম
প্রণাম করি যা আমাকে গঠন করেহত্যা করে প্রত্যহই"

---- 'মৃৎশকট'


'কবি'  এবং  'কবিতা'---- এই দুই শব্দ নিয়ে অন্তহীন চিন্তন ও মতাদর্শের বিতর্ক এড়িয়ে বা পেরিয়ে কিছু মহাপ্রাণ সৃষ্টিতে অত্যুজ্জ্বল হয়ে ওঠে কালের চির রহস্যময় পটচিত্রে যাদের দ্যুতিতে একাকার হয়ে যায় কবি ও কবিতার পৃথক সংজ্ঞাবরং স্থাপনা হয় নতুন দিগন্তেরযার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে প্রণত হওয়া ব্যাতীত আর কিছুই বোধ করি করার থাকে না সাধারন মানবের। আজ তেমনই এক মহাপ্রাণের প্রসঙ্গে আলোচনা এখানে যার একান্ত নিজস্ব বিভূতি  'মহাকবিতা'  সাহিত্যের আঙ্গিক অভিধানে বিরল সংযোজন। তিনি শ্রী দেবদাস আচার্য। কবিতা প্রসঙ্গে যার দর্শন 'নির্বিকল্প ধ্যানআর সেই ধ্যানে লীন হয়ে অতিক্রম করে চলা এক মহাজীবন।


কবি দেবদাস আচার্যের জন্ম 1942 সালের  'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'  আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিতে। বোধ করি বিপন্নবিচিত্র সেই আবহবিকারেই উপ্ত হয়েছিল ভবিষ্যত কবিত্বের মহিরূহ। "আমি জেনেছি এই বিশ্বের পারদ উষ্ণ হচ্ছে" / আমার মনে হয় অক্ষ ও দ্রাঘিমা জুড়ে মৃদু ভূকম্পন একদিন লাভা হবে" । স্পষ্ট উচ্চারণ ফোটার আগেই তিনি প্রত্যক্ষ করে নিয়েছিলেন ইস্পাহানি কোম্পানির আমলে মানবনির্মিত 1943 সালের বাংলার ভয়ংকর মন্বন্তরভুবনেশ্বরে রাজধানী স্থানান্তর, 1946 সালের বিদ্ধংসী দাঙ্গা আর তারপর 1947 সালের বঙ্গভঙ্গ। "দু পাশের সাদা দেওয়াল মাঝখানে পৃথিবীর অসুখ বাড়ছে / দু পাশের খড়গ আস্তে আস্তে নেমে আসছে সময়ের ওপর / ঘুম ও পতনের সন্ধিক্ষণে মুখোমুখি সংগ্রাম / ঘুম ও জীবনের মধ্যে রয়েছে আরো এক পরিশ্রম / এবং আমিও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠি সমসাময়িকতায় / আমার কালক্রম ও প্রতিধ্বনিসহ" ।

শ্রী দয়াময় আচার্য তাঁর স্ত্রী আশালতা আচার্য আর তাদের শিশু সন্তানগুলিকে নিয়ে 1948 এ উদ্বাস্তু অবস্থায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন অধুনা নদিয়া জেলার রাণাঘাটেতারপর বীরনগরে কিছুদিন কাটানোর পর তাদের স্থায়ী ঠিকানা হলো কৃষ্ণনগর। অদ্যাবধি সেই কৃষ্ণনগরেই কবি দেবদাস আচার্যের কর্মময় সৃষ্টিশীল জীবনের পানসি বেয়ে চলা। "নগরের প্রান্তে সিদ্ধাচার্যের বাড়ি / খড়িয়া নদীর কূলে বাগদিপাড়াবেদেদের তাঁবু /শ্ রী আচার্য গৃহীতার ক্ষুদ্র সংসার / এ নদীর নামই জলাঙ্গী নদীগঙ্গার দিকে ভেসে যায় আবহমান / গ্রামের প্রান্তে থাকেন সিদ্ধাচার্যশূন্যবাদীনির্বাণপিপাসু / ইচ্ছেপূরণের বৃক্ষে ঠেস দিয়ে পুরোহিতের সঙ্গে মৃদু ধর্মকথা বলেন / চাঁদ ওঠে এই দেশেএই পুরাকাহিনীর দেশেএকান্তই নিজস্ব ধাঁচের / ইচ্ছাবৃক্ষমূলে বসে সিদ্ধাচার্য চর্যা গান গায়" ।

দেবদাস আচার্যের বাল্য ও কৈশোরের মননক্ষেত্রটারই নির্মাণ হয়েছিল বিপ্লব আর আন্দোলনের সদা অস্থির আর সঙ্কটময় প্রেক্ষাপটে। 1953-54 সালে বাংলা আর বিহারের সংযোজন বিতর্ক এলোসম্ভাবনা তৈরী হলো বাংলার অবলুপ্তির। 1959 সালের 1st সেপ্টেম্বর থেকে দিন ধরে চলা খাদ্য আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে 31 জনের মৃত্যু আর 3,000 জনের আহত হওয়ার ঘটনা তার মানসে এক গভীর প্রভাব ফেলে। এরপর এলো প্রত্যক্ষ আগুনের আঁচ। 1966 সালে পূর্ণযুবা কবির নিজভূমি কৃষ্ণনগরেই এলো খাদ্য আন্দোলন। 3-5 মার্চের আন্দোলনে জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। "ছেলেটা না খেয়ে ম'বউটাও ভাগলদুটো খেতে পাবে বলে / কান্নায় থাকে না পাখিউদরে যদি না নিয়মিত দানা পড়ে / পেখেরার এ জীবন পাখিতে খেয়েছেওহে পক্ষীস্তাবকেরা / দু-বেলা দু-মুঠো অন্ন যদি খেতে দাও আর শিকার ধরব না" ।

তার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের দিন গুলোয় তিনি দ্রুতঅতি দ্রুত লয়ে সাক্ষী হতে থাকলেন এক জনপদের সম্পূর্ণ ইতিহাস বদলে নবধারাপাত প্রণয়নের। দেখলেন  'ক্যাম্প' , যেখানে উদ্বাস্তু সম্পন্ন গৃহস্থরা রাতারাতি কপর্দকশূন্য রিফিউজি অবস্থায় ঠাঁই নিতে শুরু করলো 10/10 খড়ির দাগ দেওয়া খোলা আকাশের নীচে সামান্য ত্রিপলের আচ্ছাদনেদেখলেন দুধে-ভাতে-মাছে থাকা অন্নপূর্ণার সংসারদের জন্য পরিবার পিছু বরাদ্দ হওয়া  'ডোল', খাদ্যশস্য ও পয়সার অনুদান। দেখলেন জবরদখল করে তৈরী হওয়া কলোনি, 'সমাজবিরোধী'  নামে এক নতুন শ্রেণীর উদ্ভব প্রাণের তাগিদের মরণপণ সংগ্রামে। 1971 এর যুদ্ধের পর দখলযোগ্য কলোনির জায়গাও শূণ্য হয়ে গেলো। উচ্ছেদ হতে শুরু করলো ঝুপড়ি সভ্যতাও। দেবদাস দেখতে থাকলেন এক জনজাতির পরিবর্তিত মূল্যবোধের কারনামা। অন্ধ জাতিভেদের হাস্যকরভাবে প্রথমে তুচ্ছ ও ক্রমে বিলীন হয়ে যাওয়ার ইতিবৃত্ত। "তখন গামবুট পায়ে বিপ্লবী গরিলার মতো মেঘ নেমে আসে / তখন রিলিফ ম্যাপের ওপর দিয়ে স্টিমরোলারের মতো / উড়ে আসে জোলাদের রঙের গামলা / উড়নচৌকির মতো ছুটে আসে চ্যাগার ও দরমার বেড়া / তখন টুপটাপ ঝুলে পড়ে আদিম ব্রিজ ও মহান বিশ্ববিদ্যালয় / বিশ্বের কবিকুল ও সংসদীয় বুদ্ধিজীবিরা বয়া ধরে টালমাটাল / তখন চাঁদ কাটাঘুড়ির মতো শূন্যতায় ভেসে যায় / এক লড়াই শুরু হয়ে থইথই / এই পৃথিবীর বুকে মুখ রাখো হে মুখ রাখো হে / সেই লোকটিও ছুটে যায় ভাঁড়ারে / আমার বাঘনখ আমার বাঘনখ"।


যদি তুমুল তথ্যাবলীকে সূচক ধরে এবার তার সৃষ্টিজগতের দিকে তাকাইদেখা যাবে প্রবল ঝড়েও নিবাতনিষ্কম্প দীপশিখাটির মতো তার উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠার রূপরেখা। ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় থেকেই টিউশান করে স্বাবলম্বী। পড়াশুনার সমস্ত সময় খাদ্যের জন্য সংগ্রামময়। 'রেশনিং-কাউনিং'  শব্দাবলিতে ক্ষয়জাত রোমাঞ্চময়তা দিবারাত্র। কবি মানসে আছড়াচ্ছে '60 এর ভাঙন দশকতাইন্দিরা গান্ধীর উত্থান। কংগ্রেস-সিপিএমের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনির্বার্য নির্দেশ করে দিচ্ছে সামাজিক দোদুল্যমানতা।

 অভিজ্ঞতা 

এখনো আমি স্বাধীন হইনিমুক্ত হইনি। এখনো আমাকে খুব সাবধানে চিন্তা করতে হয়আর বেঁচে থাকতে হয়কেননা আমি বস্তিবাসী এক শ্রমিকের সন্তান।
আমি একটু একটু করে নির্মাণ করে চলেছি আমার যাত্রার পথসব রকম ঘৃণাকেকুৎসাকেঅপমানকে অগ্রাহ্য করেই।
সম্ভব আমি ঠিক কাজই করছিকেননা আমার শত্রুদের আমি চিন্হিত করতে পেরেছিযারা কূপমন্ডুকতা ও বিদ্বেষে সামন্তপ্রভু আর ইংরেজ-হৌসের কর্মচারীদের ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে।
একদিন এক স্বাধীন আকাশের নিচে বেঁচে থাকবে আমার উত্তরপুরুষ,যাদের উপর কোনো কুসংস্কারের মানসিক অত্যাচার থাকবে না।
আজএক শ্রমিকের সন্তানএ ছাড়া আর কী-ই বা আশা করতে পারি।


এই কবিতাহীন সময়ে প্রথমে তিনি রচনা করেছিলেন গদ্য ও গল্প যেগুলি তার দশম শ্রেণীতে পাঠরত কালেই প্রকাশিত হতে শুরু করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ক্রমে হয়ে ওঠেন ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। নিজভূম কৃষ্ণনগরেই মঞ্চস্থ হতে থাকে তার নাটক। কিন্তু দৈবনির্দেশ কে উপেক্ষার চেষ্টা দেবদাস আচার্য কোনোদিন করেননি যখন গদ্যভাষার যাবতীয় আঙ্গিকে সাফল্যঅর্জনের পরেও তাঁর অন্তরের তাগিদ তাকে কবি রূপেই দেখতে চেয়েছে কারণ তাঁর কবিতার নিবিড় পাঠ অতি সুস্পষ্ট জানিয়ে দেয় একমাত্র অন্ত:স্থিত "প্রিয়নাথ" কেই তিনি ঈশ্বর হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

"ভবিষ্যত পাতলা হয়ে আসছে ক্রমশ
তিন কাল গেছেএক কাল আছে
যা গেছে তার কথা ভাবতে খারাপ লাগে
গতানুগতিক আত্মক্ষয়প্রিয়নাথএ যেন
নিজের গন্ডূষে নিজেরই বুকের বিষ উগলে পান করা,
যাকে তুমি বলো সর্বহারা!



কিন্তু সেই সময় যে ভাষায় কবিতা রচিত হতোতা তিনি গ্রহণ করেননি। সন্ধান করেছেন নতুন ভাষার। সেই উদ্দ্যেশ্যেই একাগ্র পাঠক হয়েছেন পাশ্চাত্য ভাষাসাহিত্যের আর ক্রমে হয়ে উঠেছেন রাশিয়ান ও চাইনিজ লিটারেচারে আসক্ত। তখন তিনি শ্রমজীবি স্বার্থে স্বত:স্বীকৃত সিপিএম ও বটে। "হাংরি আন্দোলন"  তাঁকে বিশেষ আন্দোলিত করতে পারেনি। সেই সন্ধান পর্বে 1964-65 সালে তার হাতে আসে ওয়াল্ট হুইটম্যানের "লিভ্স অব গ্রাস" । এই সমগ্রের ভূমিকাটি তার চিন্তন জগতে এক বিস্ফোরণের জন্ম দিলো। যা তিনি বলতে চাইছিলেন এতোদিন-  "Hate Tyrants, Despise Riches, Look Forward People" -  তা স্পষ্ট হয়ে ভাষা পেলো। এলিটিস্ট ঘরানাকে ভাঙতে হবে। নিম্নবিত্তসংগ্রামীশ্রমজীবি এদের জীবনকথাকেই যে করে তুলতে হবে কবিতার উপজীব্যসেই বিষয়ে তিনি স্থিতপ্রজ্ঞা নিলেন এবং অনির্বার্যভাবেই বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রেখে জন্ম দিলেন এক নতুন কাব্যভাষার -  "A Chaotic Form" -  এই যে মৌলিক উপাদান ও ভাষাদর্শনের প্রণয়নবাংলা কবিতার ইতিহাসে এটিই কবি দেবদাস আচার্যের মহতী অবদান।


"পাণ্ডিত্য অথবা প্রেম নয়যুক্তি অথবা কুস্তি নয়আরোপ নয়প্রতিসরণ নয়
একটি ঝিঁঝিঁপোকা গম্ভীর শব্দহীনতার মধ্যে সুর তুলছে
এটুকু ছাড়া আর কোনো অনুভূতি নয়
ওঁ শান্তিচিৎপ্রভআমাদের শতাব্দীর অভিশাপ থেকে মুক্ত করো
হে সময়ঋত্বিকআমাদের ছিন্ন করোবিস্তারিত করো দূর সময়ের দিকে
লবণ ও কার্বন দূর করোনিশ্ছিদ্র করো স্নায়ুসমূহ,হৃদপিণ্ড ক্ষারমুক্ত হোক
নাভিতে থাক শব্দব্রহ্মনীল কঙ্কালের মতো তাকিয়ে আছি এই মানব মানচিত্রে
ঐ দূরে যে মেঘ ভেসে যায় সংরাগ বহনকারী যক্ষ ও অলকানন্দার মধ্যে
তাকিয়ে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী



তাঁর কাব্যরচনার প্রথম পর্যায়  "কালক্রমের প্রতিধ্বনি"  থেকে  "আচার্যের ভদ্রাসন" । এই পর্যায়ে ভাষার বিক্ষুব্ধতা ও সংগ্রামের ছাপ সর্বাপেক্ষা প্রকট যাকে  'মিশ্রধ্বনি'  বলে বর্তমানে সম্বোধিত করা হয় প্রগাঢ় সম্মানে। এর পরবর্তী পর্যায়ে আবির্ভাব ভাষাবিক্ষুব্ধতা পেরিয়ে অন্তর্লীন ধ্যানে ডুবে যাওয়ার যাতে অনুঘটক হিসাবে কর্তব্য পালন করে তাঁর পিতার মৃত্যু। কৃষ্ণনগরের প্রত্যন্তেফাঁকা মাঠের মধ্যেজলাঙ্গী তীরবর্তী প্রায় শ্মশানসম নিস্তব্ধতায় পিতৃহীনতার অনুভূতি থেকে তৈরী হয় এক অন্তর্মুখী শোকের তর্পণ যাকে সচেতনভাবে এলিজি করে তুলতে চাওয়া হয়নি এই পর্যায়ে রচিত কোনও কবিতাতেই। একই সঙ্গে সামাজিক শ্রেণীহীনতার স্বপ্নকেও তিনি বিসর্জিত করেননি তার প্রমাণ  "আচার্যের ভদ্রাসন"  এর উৎসর্গ পত্র। সর্বকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সব কবির জন্যে তাঁর এই গ্রন্থটি উৎসর্গীকৃত। অপূর্ণতার অনুভবঅসম্পূর্ণতার তীব্রতাময় গ্রন্থগুলির মধ্যে  "তিলকমাটি"  বিশেষ উল্লেখ্য। এই পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য  'বর্জন'  এবং তা উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত অর্থাৎ  জটিল ভাবশব্দের গুরুভার ও অলঙ্কার ত্যাগ করে শুধু কয়েকটি শব্দে কবিতার আত্মাকে ধরে রাখাতে কবির উত্তরণের প্রয়াসটিই হয়ে ওঠে এক ও ঐকান্তিক। এ যেন বনের বেদান্তকে গৃহে আনার সাধনা।


অলৌকিকভাবেই আছি

অনেকদিন পর দেখলাম
সূর্যাস্ত হল
ঘন হতে হতে
একটা চিলের ডানায় জড়িয়ে গেল
চিলটি তার ডানায় লেগে থাকা ওমলেটটি নিয়ে
বাসায় ফিরল
ছানা-পোনারা সেই সূর্যাস্ত চেটেপুটে খেল


গতকাল পৃথিবীর গা ঘেঁষে
একটা প্রকান্ড মহাজাগতিক পাহাড় উড়ে গেছে
সেই মহাজাগতিক পাথর ঝড়ের মধ্যে
আমার নৌকাটি
ফুঁ দিলে টলমল.....


মনোবাসনায়তবু টিকে আছি
জগন্ময় শূন্য সমুদ্রে
নৌকা বেয়ে


সংস্কৃতির আলোকময় কলকাতাকেন্দ্রীক বৃত্ত থেকে বাল্য থেকে বর্তমান অবধি শত কিলোমিটারের অধিক দুরত্বে স্ব-ইচ্ছায় অবস্থান করে ধ্যানসঞ্জাত কবিতা ও প্রচারবিমুখ কবিজীবনের যে আদর্শকেযে ব্যাতিক্রমকে কবি দেবদাস আচার্য প্রতিষ্ঠিত করলেন তা স্বয়ং এক বিপ্লব। কৃষ্ণনগর তাঁর সাধনপীঠ যার স্বীকৃতি তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিতে। মাটির মানুষটিকে তার সৃষ্টিতত্ব নিয়ে প্রশ্ন করলে বড় অসামান্য উত্তর আসে।

"জীবন থেকে নিয়ে জীবনকে ফিরিয়ে দেওয়াএর বেশী অঙ্গীকার আমি কখনও করিনি। আমার কবিতার জীবনদর্শন -  'Art for Life's Sake'"


প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থপঞ্জি 

1, 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি' (1970)
2, 'মৃৎশকট' (1975)
3, 'মানুষের মূর্তি' (1978)
4, 'ঠুঁটো জগন্নাথ' (1983)
5, 'উৎসবীজ' (1992)
6, 'আচার্যের ভদ্রাসন' (1992)
7, 'তর্পণ' (1994)
8, 'অনুসূচিত কবিতা' (1995)
9, 'নির্বাচিত কবিতা' (1997)
10, 'সুভাষিতম' (1997)
11, 'রসাতল থেকে ফিরে' (2002)
12, 'যে আছো অন্তরে' (2007)
13, 'দুয়ারে রাখা থাক' (2009)
14, 'যা আছে,আপনারই' (2010)
15, 'তিলকমাটি' (2010)
16, 'ফটিকজল' (2012)
17, 'নাস্তিকের জপতপ' (2013)
18, 'তারপর যাব' (2014)
19, 'এই যে থাকা' (2016)
20, 'তুমিও সুন্দর' (2016)




                                                 সোনালী চক্রবর্তী



****

                দেবদাস আচার্যের একগুচ্ছ কবিতা 


  ডোম 

সবুজসুদূর সবুজ,
নীলঅখণ্ড,গভীর
পাদপীঠে নদী
এইখানে বাস করেন এক
ব্রাত্য নাগরিক
ঈশ্বরের কৃপাহীনপ্রাকৃতনাস্তিক
শূন্য অনুবাদ করেন তিনি।

রাতে ফোটে অনিমেষ পদ্মলোচন তাঁর
শূন্যের সাগরে।

কোনো ভাষা নেই তাঁরকোনো বাণী নেই
কোনো শোক নেই তাঁরকোনো প্রেম নেই,

আত্মক্ষরণ করে তিনি
মধুপান করেন।

শ্মশানের আলো এসে তাঁর মুখে পড়ে।




এই তো জীবন 

পুরুষ একবারই নারীসংসর্গ করে,প্রথমবারই,
তারপর ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি,
কেউ যদি প্রথম বার স্বৈরিণীসঙ্গ করে থাকেতবে তাকে
সেটাই তো আজীবন পুনরাবৃত্তি করে যেতে হয় অন্য নারীতেওতদ্রূপ
কারো যদি প্রথম সংসর্গ হয় ধর্ষণ সে ক্ষেত্রে তাকেও
আজীবন ধর্ষকই থেকে যেতে হয়সতীসাধ্বী স্ত্রীসংসর্গও তার ধর্ষণই।
যদি কেউ প্রেমিকার সঙ্গে সুখ ভাগ করে নেয় তবে তার
প্রেমের আগুন নিভে ভষ্ম পড়ে থাকেপোড়ামুখে
প্রতিরাতে জল ঢালে পরস্পরনিয়মিতশান্ত হতে চেয়ে।
যাদের জীবনে কোনো স্বৈরিণী বা ধর্ষিতা নেই,
যাদের জীবনে কোনো প্রেমিকাও হয়নি শয্যাসাথি,
তারাই কলঙ্কহীনশুদ্ধ ও নিস্তেজ,
বাহ্য-প্রস্রাবের মতো স্বাভাবিকচাপমুক্তস্বেচ্ছাচারহীনপ্রতি রাতে
তাদের প্রাকৃত যৌননিবৃত্তিক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস।
ঈশ্বরের ইচ্ছায় করুণা বর্ষিত হোক সকলের প্রতি।



 কৃষ্ণগহ্বর


এতদিনে বুঝেছি
দীর্ঘকাল একটা নেই-কেই পালন করছি,
সান্ত্বনা পাই এই ভেবে যে
এই থাকাটাও কোনো এক নেই-এর আবরণ দিয়ে
সুন্দরভাবে ঢাকা
আবরণটি খোলা যায় না বলেই বার বার
একটা নেই-এর মধ্যে আর একটা নেই-এর শূণ্যতা ভরে
নেই-কেই যুক্তিপূর্ণ করার চেষ্টা করি
এবং নেই-এর ভিতরকার শূন্যতা ফুলিয়ে দিইক্রমাগত....

এই যুক্তির ওপর আমার সব কর্মফল আরোপ করলাম।



  আমার প্রতিবেশীরা


আমার বাড়ি থেকে উত্তরায়ণের শেষ সীমা খুব কাছেবাহাদুরপুরে
বিকেলে কোনো কোনো দিন ওই সীমা ছুঁতে যাই একা এবং হাঁটা পথে
এখান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে --- ভৌগোলিক বিজ্ঞপ্তি পড়ি
তার পর ওই রেখার ওপর দাঁড়িয়ে ভূ-বলয় ধরে মনকে একবার ঘুরিয়ে আনি,
যে বিন্দু থেকে মনকে হাঁটতে দিয়েছিকিছুক্ষণ বাদে ভূ-প্রদক্ষিণ শেষ করে সেই বিন্দুতেই
মন ফিরে আসেআমার প্রণাম পৌঁছে দিয়েঅসংখ্য জনপদেনদীতেপর্বতে


ওই কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করে সূর্যদেবও যান না কোথাও
বৎসরান্তে একদিন আমার বাড়ির পাশের ওই রেখাটিতে এসে থমকে দাঁড়ান
কিছুক্ষণ সাদামাটা গল্প করেনকুশল জানেনআশীর্বাদ দেন
তারপর জলাঙ্গীর জলে ডুব দিয়ে স্নান সেরে পুনরায় দক্ষিণায়নের পথ ধরেন
এভাবেই তাঁর সঙ্গে আমার সখ্য হেতু পর্যাপ্ত রোদ আর আকাশ পেয়েছি
এভাবেই আমার চামড়ার রং গভীরতা পেয়ে কালো আর উজ্জ্বল হয়েছে


একটা অরণ্য আছে,যদিও কৃত্রিমতবু রহস্যময়ওই ক্রান্তীয় রেখার ওপর
একটু রুক্ষতা আছে অরণ্যের ভূমিপৃষ্ঠেকাছিমের পিঠের মতনআছে বাঁকা বিল
রাঘব-বোয়াল আছেকিংবদন্তি আছেপাখি আসে সম্বৎসর দূর-দেশ থেকে
আমার ঠিকানা পৌঁছে যায় দূরেসাইবেরিয়ায়কোনো ইগলুর ভিতর,
আছে ডাইনোসোরাসের কঙ্কালের মতো দু'টি সেতুপাশাপাশি,মনোমুগ্ধকর,
রেল আর পথ-সেতু মাথা উঁচু করেওরা আমাকে পাহারা দেয়প্রভুভক্ত হয়ে।


তারাদের সঙ্গেও আমার সখ্য হয় রাতেওই গভীর রাতের মহাকাশে
পুব থেকে পশ্চিমে টানা-পথ জুড়ে চাঁদ হেঁটে যায় পক্ষকাল জুড়ে
আর সারারাত জুড়ে তারা ছোটাছুটি করে এ-আকাশ ও-আকাশ এফোঁড়-ওফোঁড়
মনে হয় অন্তর্লোক থেকে ওঁরা বেরিয়েছেন পৃথিবীতেখেলতে নেমেছেন দলে দলে
আমার উঠোনে ওঁরা নেমে আসেন কালে-ভদ্রে ঝরা শিউলি কুড়োবার ছলে
আমার স্ত্রী আমাকে ডেকে বলেনওই যে দ্যাখোওঁরা এসেছেন ওই শিউলিতলায়

ভাবতে ভারি ভালো লাগেভাঙ্গি আর গড়ি এক অলৌকিক অনুপ্রেরণায়
আসলে স্বপ্ন আর বাস্তব মিশিয়ে এক কল্পলোক বানিয়েছি এ জগৎ জুড়ে
সেখানে বাস করি এক তাৎক্ষণিকতাবাদীউচ্চাশাহীন তুচ্ছ মানবসন্তান
ভূত ও ভবিষ্যত একটি বিন্দুতে মিশে আমাকে শূন্যে তুলে ফুঁ দিয়ে ওড়ায়



   কবি

একদিন তবু
আস্তে আস্তে ঢুকে যাই
যেন কেউ হাত ধরে নিয়ে যায়
গভীর অতলে

ফিকে নীলহলুদাভ সবুজ জল
দু-একটি সুদীর্ঘ ফার্ন খাড়ি
প্রবালকীটের খেলা
নির্ভার ভেসে থাকি
আ:কী আরাম স্বপ্নচারিতায়।

বেশীক্ষণ থাকতে পারি না
শ্বাসকষ্ট হয়ভেসে উঠি

জলের প্রাণীরা জলে থাকে
ডাঙার প্রাণীরা থাকে ডাঙায়
শুধু স্বপ্নের প্রাণীরা কষ্ট পায়



 লুমপেন শাবকের প্রতি লিরিক


তোর বাবা ছিলেন একজন লুমপেন,হাড়-হাভাতে
একদিন তোকে তোর মা শেষ স্তন খাইয়ে ঐ যেখানে ঘুরে গিয়েছে মোড়
যেখানে শহরের কাপ্তানেরা বক্তৃতা করে যান
ঐ বিখ্যাত জায়গায়শীত ও আকাশের অনন্ত নিচে
কবেকার গ্রামীণ শ্লোকের মতো রেখে চলে যান
তারপর থেকে তুই কেবল বেড়েই উঠেছিসতোর বাবারই চেনা শহরে--
বেড়ে ওঠে তোর গোঁফের রেখা ও কণ্ঠস্বর
সব কিছু স্বাভাবিকতার ভিতরে একটা দম্ভের মতোপ্রাণ
তোর বাবা ছিলেন একজন হাড়-হাভাতে লুমপেন,
বাবুদের কানে পৌঁছে দিতেন মেয়েমানুষের গল্প
তার খসখসে চামড়ার ওপর ছিল দাদময়লারোদ
কেবল তার হিসাবহীন খাঁ-খাঁ হাসির রোলে
আমাদের চামড়ার ওপর গজিয়ে উঠত ক্ষত
আর তোর মা একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ায় তোকে জড়িয়ে নিয়ে
শান্ত চাঁদের নিচে বসে
কুড়িয়ে পাওয়া ঘুঙুর বেঁধে দিতেন পায়েলাল রাংতা জড়িয়ে দিতেন কপালে
তারপর লাথি মেরে তোকে সরিয়ে দিয়ে
তোর বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে গান গেয়ে উঠতেন
একচেটিয়া নীতিবোধকে একেবারেই অস্বীকার করে,
এক গহন আড়ালের অনেক নিচে শুয়ে থাকেন তোর বাবা,
তাঁর ঠোঁটের কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত
পৃথিবী তা তৎক্ষণাৎ খেয়ে ফেলে
তোর মা অন্য এক শক্ত পুরুষের সঙ্গে তোকে রেখে চলে যান
আর তুই ঐ ঝুলবারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে হা হা চিৎকার করে
সভ্যতাকে এক বিন্দুও এগুতে দিস না
তোর বাবা ছিলেন লুমপেনফেরেব্বাজছিঁচকে মাতাল
তাপ্পিমারা হাফ-প্যান্টের পকেট থেকে মাউথঅর্গান বের করে
সুর ভাঁজতেন তিনিআর
যখন ঝিম হয়ে যেত শহরযখন শিরদাঁড়া টান করে ঘুমিয়ে পড়ত মানুষ ও সমাজসেবীরা
থুৎ করে থুতু ফেলে তোর বাবা নস্যাত্ করে দিতেন আমাদের সুপ্রভাত
আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আরও কয়েক জোড়া লুমপেন ছড়িয়ে
পড়েছে শহরে
তারপর আরও কয়েক জোড়াতারপর আরও--আরও--আরও এইভাবে
একসময় ভয়ে আমাদের শরীর শিউরে উঠতএবং আমরা সব সময়ের জন্যেই
চেষ্টা চালিয়ে যেতাম আত্মরক্ষারকিন্তু তোর মা
সকলের চোখের আড়ালে এক কিশোরী রেখে যান তোর ঘুমের পাশে
তুই হাত বাড়িয়ে দেখিসছুঁয়ে দেখিসতোর বাবার কথা মনে পড়েতারপর
তুইও সেই কিশোরীর কোমরে জড়িয়ে দিস বুনো লতাপাতাভয়ংকর দশটি আঙুলে
তার শরীর বাজিয়ে গান গাইতে থাকিস---সারারাত
সারারাত সেই গানের সুরে শহরের স্নায়ু রি-রি করে ওঠে
তোর বাবা ছিলেন লুমপেন



  সন্ধি 

আমার ব্যাঞ্জনাময় আমার ভিতরে থাকেন
আমি তার সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ-সালাপ করি
তিনি কথা বললে দু-পঙক্তি কবিতা পেয়ে যাই।

ওপরে ভেসে থাকা জীবন মিত্থ্যে নয়,
আছে হরেক রোশনাই
দু'দিনের দুনিয়ায় এসে এসব নিয়েও বেশ মজে থাকা যায়।

আমার মন জটিল পথে চলে,
প্রাণ আপন কথা বলে।
দুঃখ কি আমার এমনি বেড়ে যায়!

টুকরো টুকরো ছড়িয়ে থাকা অন্তর্গত সুখ
চলতে চলতে কোথাও পেয়ে যাই
পথের পাশেমানুষের নি:শ্বাসে।

সেসব কুড়িয়েই তো এই মন্দির গড়েছি,
এখানে থাকেন আমার ব্যাঞ্জনাময়,
সারা জীবন স্বরচিত মন্ত্রে তাঁকে বন্দনা করলাম।

এভাবেই তাঁর সঙ্গে আমার গূঢ় যাতায়াত হেতু
এক সন্ধি হয়েছে,
তিনি আমাকে ভক্ত বলেন
আমিও তাঁকে দেবতা বলেছি।



 স্বাভাবিক

এ পথেই নেমে গেছে জলআজ
খাঁ-খাঁ মাঠে কাঁকড়ার খোলঝিনুকের ভাঙা পিঠ
পড়ে আছে

এত জল সরে গেলভাবিএই হেমন্ত সকালে
শ্মশান-জাগানে পাখি একা একা রোদে শুয়ে আছে
এখানেই একদিন গড়ে উঠেছিল কোনো অস্ট্রালয়েড জনপদ
নদীটির ভাঙা পাড়ে তার মৃৎপাত্র দেখা যায়

আর কোনো উচ্ছ্বাস নেইহেমন্তের
শান্ত রুক্ষতা আজ তিল তিল অনুভব করি
আর অনুভব করি জীবন কীভাবে ধীরে প্রত্নসম্পদ হয়ে ওঠে


  জরাথুষ্ট্র বলেন

কোনো পাপ আর মানুষকে স্পর্শ করবে না
কোনো ঈশ্বর আর অপেক্ষা করবে না পুণ্যাত্মার জন্যে
নরকের দরজা আমি বন্ধ দেখে এলাম
পাপ পুণ্য স্বর্গ নরক এইসব শব্দগুলির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ
এরা দীর্ঘকাল আমার অজ্ঞতাকে বহন করেছে
আজ আমি এদের ছুটি দিলাম
ঐ পাথরের মূর্তি যিনি দীর্ঘকাল আমাদের চিত্তের প্রশাসক ছিলেন
তাকেও আমি ছুটি দিলাম অন্য কোনো নক্ষত্র খুঁজে নেওয়ার জন্যে

আজ মনে হয়জনপদের মিশ্রধ্বনির এক গান থেকে উঠে আসছি আমি



 জাতকের কথা

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকিবৃষ্টি পড়ে
পাতা উড়ে যায় ঝোড়ো বাতাসে,ব্যাঙ ডাকে
আমার প্রপৌত্রদের সন্তানেরা দল বেঁধে
ভেসে এল চারপাশেছবির মতো

বিস্ময়ে কিছুক্ষণ মূঢ় হয়ে থাকি

তারপর তাদের চিনিয়ে দিই আমার সব কিছু
জামা-প্যান্টজুতো-ছাতাবিছানা-বালিশ
আমার স্ত্রীকেও ডেকে আনি
আমাদের চারপাশে ওরা হইহই করে কিছুক্ষণ

ওদের আমি বলি, ---শোনো,
আমরা তোমাদের পূর্বপুরুষএখনো বেঁচে আছি,
তোমাদের যা বলার আছেবলে যাও
আমরা ভগবানের কাছে তা নিয়ে যাবো--
তোমরা যখন সত্যি-সত্যিই এখানে আসবেতখন
ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবেন

আমার ছাতাটি মাথায় দিয়ে
আমার চাদরটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে
তারা খুশী হয়ে চলে গেল





'বাক'  এর জন্য নবতম দুটি নির্মান----

 ডাকি

নীরবে ডেকে ডেকে
দিনগুলি
ফুরিয়ে ফেললাম


মনে হয়
বৃথা


বৃথাকিন্তু

সেও বেশ তপস্যার মতো
অন্তরের সুখ

কিছুক্ষণ
সেই সুখে ডুবে থাকি


 শীতের বিকেল

দেখতে দেখতে রোদ পড়ে এল
কুয়াশার নরম চাদরে
ঢেকে নিল
আলোর শরীর

এখন আলোর মায়াটুকু
খেলা করে

একটি পায়রা একা
নাচছে ঘুরে ঘুরে
পৃথিবীর মায়ার ভিতর

আর কোনো সুসংবাদ নেই




******


আচার্যের ভদ্রাসন :  গৌতম বসু


ভাবতে অদ্ভুত লাগেমাত্র দেড় দশক পূর্বেএই সঙ্কলনগ্রন্থের কবিতাগুলি যিনি  রচনা করেছিলেন এবংতাঁর পাঠককুলআমরাএকটি অন্য শতাব্দীর পরিধিতে বাস করতাম। আমরা যারা বিগত শতাব্দীর ষাটের ও সত্তরের দশকে কবিতা নিয়ে বিস্তরএবং এখন বুঝতে পারিকখনও-কখনও অনাবশ্যক হুটোপাটি করেছিতারা অনেকেই আজ মৃতবাকিদের জীবনীশক্তি নিম্নমুখী। ভাবছিএত এত কবিতার পাহাড় যে জমে  উঠেছেতার কতটুকুই-বা মানুষের কাজে লেগেছে ভাবছিকান পাতলে কটি  বইয়েরই-বা শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষীণ শব্দ এখনও টের পাওয়া যায়সে-বসে ভাবছি  কোন-কোন বইকে আলিঙ্গন করবে ভবিষ্যৎ!

       নদীয়া জেলার এক কোণে বসে দেবদাস আচার্য আক্ষরিক অর্থেই আকাশপাতাল ভাবলেনলিখলেন অত্যাশ্চর্য কিছু কবিতা । আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর পূর্বে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ কালক্রম ও প্রতিধ্বনি’-তে এই পঙক্তিগুলি দেখা গেল:

           সে নিড়িনি চালায় শস্যে,বিদে দেয়,খুঁটে তোলে আগাছা
             সে কাজললতার মতো মেঘ দেখলে খুঁট থেকে বিড়ি বার করে 
             সে আলাপসালাপ করে ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে
             মাতব্বরের কাছে যায় ফসলের স্বাস্থ্যের জ্ঞান নিতে
           ফসলের অসুখবিসুখে সে হত্যে দেয় বুড়োবাবার থানে
             তার স্যাঁৎলা-ধরা বোকড়া দাঁত ঝিলকে ওঠে হাসিতে
             যখন রেণু নিয়ে খেলা করে বাতাস।     
                               (‘সে নিড়িনি চালায় শস্যে’/অংশ)

বাঙলা কবিতার অচলায়তনে যেন আরও একবার ঘা পড়ল। ক্রমে-ক্রমে প্রকাশিত হতে থাকল তাঁর পরবর্তী বইগুলি আমরা ধীরে-ধীরে অনুভব করলামতাঁর ভিতর দিয়ে প্রাক্‌-ইতিহাস কথা কইতে শুরু করেছেজীবাশ্ম প্রবেশ করেছে তাঁর রক্তস্রোতেকালপ্রবাহে ধুলোয় মিশে-যাওয়া বাঙলার প্রাচীন জনপদগুলি যেন সরব হয়ে উঠছে আবার। অজ্ঞাতকুলশীলছাপোষা সাধারণ বাঙালীর হাত ধরেই বাঙলা কবিতা পথ চলে এসেছে দীর্ঘকালকিন্তুবোধ করিসপ্তদশ শতাব্দী-পরবর্তী নানা প্রান্তেরভিতরের ও বাইরেরনানাবিধ আঘাত সে-পরম্পরাকে টানতে-টানতে সমূহ ধ্বংসের মুখে এনে ফেলেছিল। এই প্রেক্ষিতেদেবদাস আচার্য-র কবিতা একটি বিপরীতমুখী স্রোতসাহিত্য-ইতিহাসের আত্মসংশোধন-প্রক্রিয়ার একটি সুচিহ্ন।                              

       প্রথমে,মৃৎশকট(প্রথম প্রকাশ:১৩৮২/১৯৭৫)এবং তার  তিন বছর পরে মানুষের মূর্তি’(প্রথম প্রকাশ:১৩৮৫/১৯৭৮)প্রকাশলাভ করার পর আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম একজন লেখকের ভিতরপ্রায় একই সময়েদুটি পৃথক কাব্যধারার উন্মেষ। মৃৎশকট’ কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখতে পেলাম বিরাটকেএবং তার ঠিক বিপরীতে, ‘মানুষের মূর্তি’-তে প্রস্ফুটিত হল ক্ষুদ্রের গৌরবগাথা। নতুন ছন্দোজ্ঞানবিষয় মাহাত্ম্যভাষার কর্কশতাকে আত্তীকরণ  প্রতিটি নিরিখেই দেবদাস আচার্য  দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তাঁর সেই সময়ের কবিতার পাঠকবর্গের কেউ-কেউ হয়তো স্মরণ করতে পারবেন ছুতোর কাকাঘরামি কাকাবুড়িমা আর মিস্ত্রী দাদু বাঙলা কবিতার মূল প্রাঙ্গণে প্রায় হুড়মুড় করে প্রবেশ করে সকলকে কীভাবে হতচকিত করে দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়এই বিরল ঘটনাটি আমাদের কয়েকজনের যৌবন-কালের ব্যক্তিগত স্মৃতি হয়েই রয়ে গেল। আজকের গ্রামবাঙলার ও মফস্বলশহরের কোনও নবীন কবি সম্যক জানতেই পারলেন নাতাঁর বেড়ে-ওঠা এবং নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার নেপথ্যে দেবদাস আচার্য-র অবদান কত ব্যাপক এবং কত গভীর । কতিপয় উঁচু প্রাচীর টেনে নামিয়ে এনেছিলেন দেবদাস আচার্যতিনি না থাকলে এপার বাঙলার কবিতায় কলকাতাকেন্দ্রিকতা আরও ভয়াবহ একটা চেহারা নিতএ-অনুমানে কোনও ভুল নেই।

     দেবদাস আচার্য-র হাত ধরে প্রান্তিক মানুষেরা ফিরে আসতে শুরু করেছেন বাঙলা কবিতায়কিন্তু তাঁর লেখা সেখানে থেমে থাকে নি। কখনও তিনি ফিরে  গেছেন সুদূর অতীতেকখনও বর্তমানের প্রহারের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছেন। তর্পণ’ কাব্যগ্রন্থটি(প্রথম প্রকাশ:১৪০০/১৯৯৪)পড়তে বসে মনে হল আমরা যেন একটি তৃতীয় অভিমুখে এসে দাঁড়ালামএকটি ভিতরপথে যাত্রাএকটি অবগাহন প্রত্যক্ষ করছি যেন। এই ধারাটিই ভিতরে-ভিতরে এখনও এগিয়ে চলেছে বলে মনে হয়তাঁর পরিণত কবিমন ও জীবনের এতগুলি বছর নিজের অন্তরে টেনে নিয়েছে এই ধারা সামাজিক বৈষম্য ও মানুষের আর্থিক অনটনের প্রসঙ্গটি তাঁর কবিতায় উপস্থিত থেকেও যেন পিছনের সারিতে সরে গেছেনা-পাওয়ার ক্ষোভ যেন ধুয়ে পরিস্রুত হয়ে জেগে উঠেছে ছোট-ছোট অসংখ্য প্রাপ্তিযোগেসেই নুলো গেঁয়ো গায়ক আর তার অন্ধ বউপাতার আড়ালে ডালে বসে থাকা একটা পাখি!   

*

    শ্রেষ্ঠ কবিতার শিরোনাম দিয়ে তাঁর কবিতার বইগুলির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিনিধিত্বমূলক লেখাগুলি চয়ন করে যে কাব্যসঙ্কলনটি ২০০৮ সালে আদম’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিলতাপ্রকাশকের ঘোষিত ও অঘোষিত সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেওতার প্রাথমিক কাজ সার্থকতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছে বলে মনে হয়। পরবর্তী প্রজন্মের কবিতাপাঠকগণযাঁরা অনেকেই হয়তো ইতিপূর্বে দেবদাস আচার্য-র কবিতার   বইগুলির প্রথম সংস্করণ চোখেও দেখেন নিতাঁরাও তাঁর কাব্যপ্রয়াস-বিষয়ে অবহিত হতে পেরেছেন। বস্তুতদুর্বল বিপণন ব্যবস্থার সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বইটি জেলায়-জেলায় ছড়িয়ে-পড়ার পরআজ এক বছরেরও বেশি সময় হলনিঃশেষিত। শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রথম সংস্করণে কালক্রম ও প্রতিধ্বনি’(প্রথম প্রকাশ:১৩৭৭/১৯৭০) থেকে শুরু করে যে আছো অন্তরে’(প্রথম প্রকাশ:১৪১৩/২০০৭)সাঁইত্রিশ বছর জুড়ে বারোটি কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত রচনা ও ঊনপঞ্চাশটি অগ্রন্থিত কবিতা সঙ্কলনভুক্ত হয়েছিল।

    প্রথম সংস্করণ ফুরিয়ে-যাওয়ার ঘটনাটি আমাদের সামনে একটি সুখময় সম্ভাবনা এনে উপস্থিত করল।কবির সমস্ত লেখা,বিশেষত ২০০৭-পরবর্তী সমূহ  গ্রন্থিত ও  অগ্রন্থিত রচনা আবার ফিরে পড়বার একটা সুযোগ আমরা পেলাম। শ্রেষ্ঠ কবিতার পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে দেবদাস আচার্য-র কাব্যচর্চার একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আমরা করেছি। প্রসঙ্গতপ্রথম সংস্করণের সম্পাদকের অনুকথন’ অংশে(পৃষ্ঠা ২৩০-২৩২)একটি ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছিল। অতিদুষ্প্রাপ্য প্রথম কাব্যগ্রন্থ কালক্রম ও প্রতিধ্বনি’-র একটি কপি সরবরাহ করার জন্য আমরা ঋণস্বীকার করেছিলাম বটেকিন্তু আমাদেরই অসাবধানতার কারণে সাহায্যকারীর নামে ভুল রয়ে গিয়েছিল;তাঁর সঠিক নাম:তপন ভট্টাচার্য। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
    
     রোগভোগে যুগপৎ জীর্ণ এবং সদাপ্রসন্ন কবি দেবদাস আচার্য-র প্রতি, ‘আদম’ সংস্থার কর্ণধার-ফেরিওয়ালা তথা কবি-সম্পাদক গৌতম মণ্ডল-এর প্রতিনতুন করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সমস্ত ক্ষমতা ও সুযোগ  লিখতে পারারকাজ করতে পারার ক্ষমতা ও সুযোগযা পাঠ করলাম তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারার ক্ষমতা ও সুযোগএমন কি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের সুযোগও  পুরাকালের দিব্যাস্ত্রের মতোশূন্য হতে নেমে যেমন আসেঠিক তেমনইউপযুক্ত সময় উপস্থিত হলে তা প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয় । কর্মচাঞ্চল্য’-র আত্মগৌরব মানুষকে এই সত্য ও বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েতাকে ধ্বংস করার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে । অথচপ্রত্যহ সকালে ও সন্ধ্যায়, এই কথাটি মনে রাখার মতো সহজ কাজ আর নেই!     





কার্ত্তিক ১৪২৩ / অক্টোবর ২০১৬
শ্রেষ্ঠ কবিতা (দ্বিতীয় সংস্করণ)দেবদাস আচার্য /আদম
সম্পাদকের  অনুকথন


******



জনপদের মিশ্রধ্বনিময় গান : গৌতম চৌধুরী

অকালপ্রয়াত কবিবন্ধু অনন্য রায়ের মুখে একদা একটি আখ্যান শুনেছিলাম। বিগত শতকের সত্তর দশকের কোনও অগ্নিবর্ষী দিনেতরুণ এক স্বপ্নদ্রষ্টার পাঁজরে এসে বিঁধেছিল সংবিধানসম্মত কিছু জ্বলন্ত সীসের টুকরো। মৃতজ্ঞানে তিনি পথপার্শ্বে রাষ্ট্রকর্তৃক পরিত্যক্ত হন। কিন্তু প্রাণ সে-যাত্রা জয়ী হয়। পুনর্জীবিত তরুণটিযিনি অনন্যর কোনও নিকট পরিজনই ছিলেন সম্ভবতহাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তাঁকে শোনান সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার বিবরণ – ‘বুঝলিগুলি বুকে এসে লাগার প্রায় সাথে সাথেই তো চেতনা হারালাম। বোধহয় এক লহমারও ভগ্নাংশ। কিন্তু কী আশ্চর্যঐটুকু সময়ের মধ্যেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলসেই ছোট্টবেলা থেকে এই গুলি লাগার আগের মুহূর্ত অবধি ঘটে যাওয়া সারবাঁধা দৃশ্যগুলো। যেন একটা ফিল্মই তুলে রেখেছিল কেউতলিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলাম এক ঝলক!’
     অবধারিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেককেই আপন জীবনকথার কালানুক্রমিক পৃষ্ঠাগুলি স্পর্শের অনুরূপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কি নাজানা নেই। কিন্তু যেসব জীবনচর্চা খণ্ড খণ্ড করে উৎকীর্ণ হয়ে থাকে কালের বধির পটেসেইসব সৃজনশীলতার ধারাবাহিক সাক্ষরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়জীবনের কোনও এক বিশ্বরূপ দর্শনের গভীরতায় ও বৈচিত্র্যে আমরা যে অভিভূত হইসেকথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। যখনই কোনও মহৎ ছবি-আঁকিয়েভাস্কর বা চলচ্চিত্রকারের রচনার একটি আনুপূর্বিক প্রদর্শনীর সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য ঘটে আমাদেরসৃজন ও নির্মাণবিন্যাসের গহনতার অনুধাবনে যেন এক বিপুল অরণ্যভ্রমণেরই রোমাঞ্চ জাগে। সময় থেকে সময়ান্তরে ছড়িয়ে থাকা পুঞ্জ পুঞ্জ ব্যক্তিত্বের ছটায় যেন কিছুটা বিমূঢ়ও হয়ে পড়ি আমরাস্রষ্টার প্রকৃত ব্যক্তিস্বরূপ-টিকে বিনির্ণীত করতে। তবুউল্লেখিত সৃজনমাধ্যমগুলিতে স্রষ্টার ব্যক্তি-উপস্থিতি ন্যূনতম। বিমূর্ত অবচেতন বা আখ্যানের জটাজটিল প্রাবল্য সৃজকের মুখাবয়বটিকে বহুদূর অবধি আড়ালে ঢেকে রাখেযেমন রাখে কথারচয়িতাদেরওযদি না তিনি স্বেচ্ছায় আত্মপ্রতিকৃতি আঁকতে বসেন। কবিদের সে-আত্মগোপনের সুযোগ ক্ষীণ।
     চূড়ান্ত নৈর্ব্যক্তিক কবিতাও কবির প্রত্যক্ষ কণ্ঠস্বরের স্পর্শসঞ্জাত। বলা বাহুল্যশ্রুতিগম্য কোনও স্বরের কথামাত্র নয়তাঁর সতত সংলাপরত শরীরি উপস্থিতির আভাসই যেন কবিতার ভিতর দিয়ে পেতে থাকি আমরা। সকল কবিতাই তো এক অর্থে সংলাপআত্মার বিরহমোচনের এক আরক্ত উড্ডীন প্রয়াস। কবিকেই তাই বলতে পারিআদিমতম ব্যক্তিকারণ নিজের অপূর্ণতাগুলি দৃশ্য-অদৃশ্য শ্রোতার কাছে ব্যক্ত করার প্রযত্নেই কোনও এক পূর্ণতার স্পর্শ পেতে চান তিনি।
     বিশ্বচরাচরের রহস্যশিহরেই হোকসমাজবিবেকের তাড়নাতেই হোকলিঙ্গশারীরিক বিহ্বলতাতেই হোক বা আত্মনির্মাণের নিষ্ফলতার বেদনাতেই হোককবিতার ভিতর দিয়ে একটি আলোড়িত হৃদয় যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে তার শোণিত-নির্ঝরের অকুণ্ঠিত তরঙ্গ-লহরী। কবি আর তাঁর পাঠকের মধ্যে তাই অবগুণ্ঠনের কোনও অবকাশ নেই। তাই পাঠক যখন কোনও কবির সমগ্র কবিকৃতি বা তার একটি সুনির্বাচিত সংকলনের পাঠপরিক্রমণে রত হনতখন যেন সমগ্র কবি-জীবনই খণ্ডে খণ্ডে তাঁর কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। অনন্য-আখ্যানের সেই গুলিবিদ্ধ তরুণটি যেমন দেখতে পেয়েছিলেন নিজেরই জীবনের এক চলচ্ছবিআমরাও দেখতে থাকি কবিকেকীভাবে তিনি নিজের জীবনের সুধামর্মরহলাহলওউজাড় করে দেন কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। কবিজীবন আর কবিতাজীবন হয়ে ওঠে সমার্থক। এই উপলব্ধি আরও গহন হয়ে বাজেযখন একজন কবি স্বয়ং জানিয়ে দেন –  

        জীবন আমাকে যা দিয়ে থাকে
        আমি তাই কেবল
        জীবনকে ফিরিয়ে দিতে পারি। এর
        বেশি শিল্প আমি পারি না,
        এর বেশি অঙ্গীকার আমি করিনি

.
বাংলা কবিতার পাঠকমাত্রেই সদ্য-উদ্ধৃত কিংবদন্তীপ্রতিম উচ্চারণটির সাথে আজ পরিচিত। একথাও আজ অজানা নেই যেএই উক্তিটি যাঁরউত্তর-জীবনানন্দীয় বাংলা কবিতার দুটি নতুন অভিমুখ আশ্চর্যজনকভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তাঁরই প্রবর্তনায়তিনি দেবদাস আচার্য। কলকাতা নগরী থেকে শত কি.মিদূরেএক প্রাচীন জনপদ কৃষ্ণনগরে তিনি উদ্যাপন করলেন তাঁর সমস্ত কবিজীবনদীর্ঘ ৪দশকের নিরলস সাধনায়। সিদ্ধিলাভের জন্য তাঁকে ভূমিচ্যুত হতে হল না। বরং রাজধানীই দৌড়ে গেল তাঁর কাছে। দৌড়ে গেল পুরুলিয়া থেকে কোচবিহারসারা প.বাংলার নবীন প্রজন্ম। তাঁর মৃৎশকট (১৯৭৫আর মানুষের মূর্তি (১৯৭৮আওড়াতে আওড়াতে। তাঁর ঠুঁটো জগন্নাথ (১৯৮৩বা আচার্যর ভদ্রাসন (১৯৯২বা সুভাষিতম (১৯৯৭)-এর বিভিন্ন বাচনে স্তম্ভিত হতে হতে। অথচ এই সুদীর্ঘ কালপর্ব জুড়ে তাঁর একটি হরফও কোনও বাণিজ্যিক মহাপত্রে দেখা গেল না। কোনও ব্যবসায়িক প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রসূত হল না তাঁর সুবিপুল রচনার সামান্যতম নিদর্শনও। যেন কারবালা প্রান্তরের নিষ্ঠুর শোকদৃশ্যটিই পুনরভিনীত হচ্ছিল প.বঙ্গীয় এজিদদের আয়োজনেজলহীনতায় অবরুদ্ধ কবিতাপুরুষের অকালনিষ্ক্রমণ অবধারিত ভেবেছিল যারা। কিন্তু দেবদাস ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। খ্যাতি ও যশোলিপ্সার যাবতীয় ইঁদুরদৌড় থেকে দূরে থেকেপ্রকৃত সাধকের জীবন বেছে নিলেন তিনি জলাঙ্গীর তীরে। আরসস্তা খসখসে লালচে ন্যাপা কাগজের আভিজাত্যে একে একে প্রকাশ পেতে থাকল তাঁর আদি ও মৌল কাব্য-গ্রন্থগুলি। এবং তৎসম্পাদিত ভাইরাসযা তরুণতর কবিদের আশ্রয়স্থান হয়ে উঠেছিল একদিন।
     সাধুতা নিঃসন্দেহে একটি উচ্চকোটির মানবীয় গুণ। কিন্তু নিছক নির্লোভ কৃচ্ছ্রসাধনার জীবনাদর্শের কারণেই কেউ কবি হিসাবে ঘরে ঘরে পূজিত হন না। এবং একথা বাস্তবিক কোনও অতিশয়োক্তি নয়যেতরুণতম বাঙালি কবি-মাত্রেরই অন্তরে দেবদাস আচার্য এক উত্তুঙ্গ শ্রদ্ধার আসনে আসীন। এই অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ৩দশক আগে প্রকাশিত তাঁর দুটি ভিন্নমুখী কাব্যগ্রন্থমৃৎশকট ও মানুষের মূর্তি-র দ্বিবিধ উপস্থাপনায়। অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের একাধিক প্রধান কবি যে এই দুই গ্রন্থ থেকে সানন্দে বীজ সংগ্রহ করেছেনতা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। এ-গ্রন্থযুগলের কয়েকটিমাত্র পঙ্ক্তির পাঠ থেকেই আমরা অনায়াসে সেই উত্তরাধিকার শনাক্ত করতে পারি –  

গাঢ় দৃপ্ত একটি ছোট্ট নীহারিকাসবুজনীল ও ধূসর বর্ণপ্রচ্ছেদে আবৃতএই-খানেই মানুষের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এই যে আমার শরীরের গুল্ম ও ছত্রাক শ্যাওলা ও পিচ্ছিল কীটাণু পরিবর্তিত হয়মধ্যে মধ্যে আবর্তিত হয়আমার রোমকূপের মধ্যে ডুবে যায়এই আমার প্রাণ এই আমার বিকাশ।                                শ্লোক ৩৬ / মৃৎশকট

কোটি অনুপল ব্যাপ্ত স্তব্ধতার ওপর ঝরে পড়ে জীবাণুময় রশ্মিকণা মানুষ তার পরিমাপ জানে না। কিছুই থাকে নাস্পন্দন ছাড়া। তার জ্বলে তুষের আগুন ক্ষার গন্ধক জলীয় বাষ্প ধুয়ে দেয় তার অম্লশূল।
                                                          শ্লোক ৬৭ / মৃৎশকট

     আমি ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ ও রাজাভাগাড়ের ডোম
         উর্বশীর গর্ভফুলকঙ্কালযযাতির রেতঃ
         সৃষ্টি ও ধ্বংসের বিন্দুতে হঠাৎ বিদ্যুৎ
        এক কোটি বছর ধরে ঠেলে এনেছি আজকের প্রচ্ছদ         
                                                               শ্লোক ৭৬ / মৃৎশকট
                                                               
     ঐ আমার বাবা হেঁটে যাচ্ছেনধুকড়ি গায়ে
        তাঁর হাঁটু অবধি ধুলো
         তাঁর চলার পথে বেজে উঠছে
         শঙ্খঘণ্টাখিদেশ্রম –                            বাবা / মানুষের মূর্তি

         আর ঐ গ্রামের দিকে বাজে খোল
        আর ঐ বাঁওড় ঘিরে উপকথা
        আর ঐ ছাতিম গাছের নীচে লৌকিক টোটেম
        এরই মধ্যে তোমাকে নিয়ে জনশ্রুতি গড়ে উঠেছে
        গ্রাম্য পদ্যকার লিখছেন পদাবলি
        গ্রাম্য মহিলারা ধান ভানছেন আর
        করুণ আর গ্রাম্য সুরে গাইছেন
        সেই নগরবিবির কেচ্ছা            উপকথা / মানুষের মূর্তি

     বাংলাকবিতার একটি মঞ্চসফল ধারায় অচিরেই –  নীহারিকাশরীরের গুল্ম ও ছত্রাকশ্যাওলা ও পিচ্ছিল কীটাণুকোটি অনুপল ব্যাপ্ত স্তব্ধতাজীবাণুময় রশ্মিকণাতুষের আগুনক্ষারগন্ধকউর্বশীর গর্ভফুলকঙ্কালএক কোটি বছর ধরে ঠেলে আনা প্রচ্ছদ ইত্যাদির ক্রমাগত দেখা পেতে থাকেন পাঠকনানা প্রতিভাদীপ্ত রূপান্তরে। আর এক নিম্নবর্গীয় ধারায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন – ধুকড়ি গায়ে হেঁটে যাওয়া বাবাতাঁর চলার পথের শঙ্খ-ঘণ্টাগ্রামের দিকের বেজে ওঠা খোলছাতিমগাছের নীচের লৌকিক টোটেমগ্রাম্য পদ্যকারের পদাবলিমহিলাদের ধান ভানা। তরুণ থেকে তরুণতরদের রচনায় এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে এইসব অনুষঙ্গআলোবাতাসের মতো ক্রমেই এমন সাবলীল হয়ে ওঠে সেই ঋণযেউত্তরসাধকেরা হয়তো এদের উৎসমূল সম্বন্ধেইওয়াকিবহাল থাকেন না আর। তার একটা কারণ বোধ হয় এই যেমুদ্রণপূর্ব পুঁথির মতো এই কবিতাবই দুটিও কালক্রমে দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। এবং কে না জানেদুষ্প্রাপ্যতাই কিংবদন্তীর জনক।

.
হাল আমলে মানুষের মূর্তি-র একটি পুনর্মুদ্রণ ঘটেছে বটে। অন্যথায় দেবদাস আচার্যর সমগ্র রচনাবলিই দুষ্প্রাপ্যযেহেতু তা সম্পূর্ণতই ছোট কাগজের বা ছোট প্রকাশনার প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে এযাবৎ প্রকাশিত হয়ে এসেছে। ১৯৯৭তে প্রকাশিত নির্বাচিত কবিতা-র পর আরও এক দশক অতিক্রান্ত। ইতিমধ্যে সুভাষিতম সমেত আরও কিছু গ্রন্থের প্রকাশ ঘটে গেছে। কাজেইবিগত ৪দশকেরও বেশি সময় ধরে রচিত তাঁর অগণিত কবিতার একটি সুনির্বাচিত সংকলনের প্রয়োজনীয়তা পাঠকের দিক থেকে বহু দিন ধরেই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই বাস্তবতার অনুধাবন ২১শতকের সূচনালগ্ন অবধি প.বঙ্গীয় প্রকাশন ব্যবস্থাপনায় অস্বীকৃত থেকে গেল। টন টন মুদ্রিত কাগজের কিম্ভূত পাহাড় প্রসব করে তাঁদের স্বঘোষিত আত্মতৃপ্তি ভবিষ্যৎ গবেষকদের কৌতুক জোগাবে হয়তো। চলমান কালের সেই দাবিমোচনের জন্য অবশেষে তাই এগিয়ে আসতে হল আর একটি দুঃসাহসী ছোটকাগজকেই। আদম পত্রিকার উদ্যোগে এই বইমেলায় (২০০৮প্রকাশিত হল দেবদাস আচার্যর শ্রেষ্ঠ কবিতা-র একটি সংকলন। অতঃপর এই গ্রন্থটির ভিতর দিয়ে দেবদাসের মানস পরিভ্রমণে কথঞ্চিৎ প্রয়াসী হওয়ার সুযোগ পেলেন উৎসাহী পাঠক।
     বাস্তবিক আমরা পুনর্বার বিস্মিত হওয়ার উপলক্ষ পেলাম আচার্যর কবিপ্রতিভার বিস্তার ও গভীরতার একটি সামগ্রিক পরিচয় এইভাবে এক মলাটের বাঁধনে পেয়ে। কালক্রম ও প্রতিধ্বনি (১৯৭০দিয়ে যখন তিনি শুরু করেছিলেনতখন যে শুধু বয়সোচিত তারুণ্যের স্পর্ধাই তাঁর সম্বল ছিল তাই নয়বেবাক দুনিয়াদারিটাই যেন ছিল এক স্বতন্ত্র ভাষার জগৎ -

তখন ঝাউবন টপকে সমুদ্র শহরে ঢুকে যায়
তখন টুপটাপ ঝুলে পড়ে আদিম ব্রিজ ও মহান বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বের কবিকুল ও সংসদীয় বুদ্ধিজীবীরা বয়া ধরে টালমাটাল
তখন শব্দ রেলগাড়ির মতো হুস হুস ছুটে আসে
খিড়কি ও ম্যানহোল টপকে ঝমঝম ঝমঝম
                      হোলাল্লা হুস্বাল্লা
এক লড়াই শুরু  হয়ে থইথই
এই পৃথিবীর মুখ রাখো হে মুখ রাখো হে
সেই লোকটিও ছুটে যায় ভাঁড়ারে       আমার বাঘনখ
                             আমার বাঘনখ      
          ঝড় : সত্তর দশক / কালক্রম ও প্রতিধ্বনি

     সেই টালমাটালে কবিও প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেন সমসাময়িকতায় – ‘এবং আমিও হা-হা করে বলি/একটি দামামা দাও একটি দামামা কারণ ‘কবির লড়াই শুধু আলুথালু শব্দের হুকুম নয় প্রথাগত কবিতার প্রতি সহজাত বিরূপতা এক নতুন ভাষার জন্য তাঁর অন্তরকে উদ্বেল করে তুলল। কিন্তু ভাষা তো প্রত্যক্ষণের অবলম্বন মাত্র। দেশকালের প্রতি তাঁর দ্বিবিধ দৃষ্টিক্ষেপ এসময়ই সূচিত হ

 আমি জেনেছি এই বিশ্বের পারদ উষ্ণ হচ্ছে
     আমি জেনেছি পৃথিবীর ফুসফুস অপারেশন থিয়েটারে আনা হয়েছে
    আমি জেনেছি একদিন মহাজাগতিক অগ্নিপিণ্ড হয়ে পৃথিবী পর্দা ছিঁড়ে
         ভেসে যাবে
     আমি সোচ্চার হয়ে উঠেছি অন্তর্গতভাবে
     দুপাশে খাড়াই কালো প্রাচীরমাঝখানে উদ্যত খড়্গ
       আমাদের কালক্রম ও প্রতিধ্বনি / কালক্রম ও প্রতিধ্বনি

   সে নিড়িনি চালায় শস্যেবিদে দেয়খুঁটে তোলে আগাছা
       সে কাজললতার মতো মেঘ দেখলে খুঁট থেকে বিড়ি বার করে
       সে আলাপসালাপ করে ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে
       মাতব্বরের কাছে যায় ফসলের স্বাস্থ্যের জ্ঞান নিতে
       ফসলের অসুখেবিসুখে সে হত্যে দেয় বুড়োবাবার থানে
       তার স্যাঁৎলা-ধরা বোকড়া দাঁত ঝিলকে ওঠে হাসিতে
       যখন রেণু নিয়ে খেলা করে বাতাস
               সে নিড়িনি চালায় শস্যে / কালক্রম ও প্রতিধ্বনি

     একদিকে মহাজাগতিক অগ্নিপিণ্ডঅন্যদিকে হাসিতে ঝিলকে ওঠা স্যাঁৎলা-ধরা বোকড়া দাঁতের উপস্থিতিতে বাংলা কবিতায় এক নিঃশব্দ বিপ্লবেরই যেন ‘দামামা’ বেজে উঠল। পরবর্তীতে যা থেকে উৎসারিত হল পরপর দুটি বিস্ফোরণ – মৃৎশকট ও মানুষের মূর্তি মৃৎশকট-এ কবি চাইলেন নিজের ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করে আরও বড় অস্তিত্বের দিকে যেতেযেখান থেকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখা যায় সৃষ্টি আর ধ্বংসের অবাধ সঞ্চরণ –  

প্রণাম করি আলম্ব ইতিহাসযুদ্ধজরায়ু ও উন্মেষ
ভ্রম ও সচেতন সঞ্চরণশীল ধ্বংসঅপরূপ নির্মাণ
ত্যাগ ও রতিসুখকিংবদন্তী ও মৌল সংগীতশব্দদ্রুম
প্রণাম করি যা আমাকে গঠন করেহত্যা করে প্রত্যহই
          বন্দনাস্তবক / মৃৎশকট

     বাংলার গ্রাম-শহরতলির নিম্নবিত্ত সমাজের প্রত্যক্ষতা থেকে শুরু করে চর ও অচরের প্রতিটি অস্তিত্ব অহরহ একটি পরিপূর্ণতার দিকে পৌঁছাতে চাইছে। একটি দীর্ঘ দীর্ঘ সময় পরে হয়তো সেই অর্জিত পূর্ণতাও লয়প্রাপ্ত হবে। তবু আজকের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রাণ-বস্তু-ভাষা-মন-সমাজ-ব্যক্তি – সকলই নিরন্তর সংগ্রামশীল। পূর্ণতাকে স্পর্শ করার লক্ষ্যে অস্তিত্বের এই সক্রিয় উন্মুখতা হল মৃৎশকট-এর অবলম্বন। আর মানুষের মূর্তি-তে কবির মুগ্ধ দৃষ্টি এসে পড়ল ঘরের কোণের সেই মৃদু প্রদীপটির দিকেনিম্নবিত্ত পরিবারের দিনান্তিক চরিতার্থতায় যার আলো অসামান্য হয়ে ওঠে। মনে হয় – ‘প্রতি সন্ধ্যাই যেন আমাদের দেওয়ালির সন্ধ্যা নশ্বর জীবনের সেই আবহমানতা এমনই প্রবল , যেতার কাছে সমস্ত উপপ্লবও যেন স্তগিত হয়ে যায় –  

        এই আগ্নেয়গিরি সবাই ভাবে মৃত
        চারিদিকে পাহাড়ি ঝোপঝাড়দু-একটি ছাগলও চরে ফিরে বেড়ায়

       মৃতমৃতমৃত!
       একদিন কি প্রতিবাদ হবে না এর? – না হওয়াই ভালো
       ছোটো ছোটো কুঁড়েকুঁকড়োপুঁইমাচা নিয়ে
       তার চারদিকের সংসার –
       প্রতিবাদ না হওয়াই ভালো।             আগ্নেয়গিরি / মানুষের মূর্তি

     মানুষের মূর্তি-র এই ইহলৌকিক অনুভবের তরঙ্গবিস্তারই যেন নতুন পরিসর পায় ঠুঁটো জগন্নাথ-যেখানে অধিকন্তু যুক্ত হয়েছে স্বপ্নদ্রষ্টার বিজন বেদনাবোধ –

জলের প্রাণীরা জলে থাকে
ডাঙার প্রাণীরা থাকে ডাঙায়
শুধু স্বপ্নের প্রাণীরা কষ্ট পায়                   কবি / ঠুঁটো জগন্নাথ

     দৈনন্দিনতার অপূর্ণতা থেকে উঠে আসা ক্ষোভ ও ক্রোধ আছে এখনও। সেই ১৯৮২তেই কবির নজর এড়ায় না – ‘আমাদের পাড়ার সেই ক্যাডার /ছোট্ট এক হিটলার/ আমি তাকে দেখেও শিহরিত হই তবু এইসব অব্যবহিতের বেদনা ছাপিয়ে এখানে বেজে ওঠে এক অন্তর্গত বিপন্নতাজীবনানন্দ-উত্তরআধুনিকতা-উত্তরএক অন্বেষণকামী বিপন্নতা –   

          একজন মানুষকে আমি হাঁটিয়ে দিই আমার সামনে
          সে হাঁটতে হাঁটতে ফুরিয়ে যায়তখন আবার
          একজন মানুষকে তার খোঁজে পাঠাইসেও একসময় ফুরিয়ে যায়
          এইভাবে অনেক মানুষ আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে যায়,
          তাদের কোথাও কোনোদিনও খুঁজে পাই নাতবু খুঁজি
                                     বিপন্নতা / ঠুঁটো জগন্নাথ

     উৎসবীজ নামের দীর্ঘ কবিতার সংকলনে (১৯৯২অনুরূপভাবে ঘটেছে যেন মৃৎশকট -এর কেন্দ্রীয় ভাবের বিস্তারআরও গভীর এক সংহতিতে –

আমি সূক্ষ্মঅতিজাগতিক
চেতনার ধারাস্রোত থেকে
ছিটকে আসা পরমাণু এক,
রূপহীনমায়া-কায়া-হীন
মৌল অণুপৃথিবীতে এসে
তার রসায়নে মিশে গেছি।                উৎসবীজ / উৎসবীজ

     এইভাবেবিশ্বমর্মের তরঙ্গ এসে মেশে কবির মর্মবিশ্বেযার রহস্যটান তাঁকে কেবলই নিয়ে চলে আরও অনাবিষ্কৃতের দিকে।

.
যদি বলিবিস্ময়ের অপর নাম দেবদাস আচার্যপ্রিয় পাঠিকা-পাঠকঅনুগ্রহ করে বিস্মিত হবেন না। আপনাকে শুধু ঠাহর করতে হবেউৎসবীজ -এর পাশাপাশিসেই কলকাতা বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯২তেই প্রকাশিত হল তাঁর আরও এক আশ্চর্য গ্রন্থআচার্যর ভদ্রাসন বিশ শতকের শেষ লগ্নের লৌকিক বাংলায় এসে পড়ল হাজার বছর আগের জাতিস্মর আলো। চর্যাপদের জগৎ যেন নতুন বয়ান পেল কবির কলমে – একদিকে তার প্রান্তিক জীবনের প্রেক্ষাঅন্যদিকে তার দার্শনিক রহস্যময়তা। এক অনায়াস ভঙ্গিমায় কবি স্বয়ং আসীন হলেন সেই আদি সিদ্ধাচার্যদের সাধনপীঠে।

  নগরের প্রান্তে সিদ্ধাচার্যের বাড়ি
    … খড়িয়া নদীর কূলে বাগদিপাড়াবেদেদের তাঁবু
    আচার্যর অস্তিত্ব চেটে চেটে খায় ঐ বাড়িঐ অতিপ্রাকৃতিক
    বেদুইন বাঁশিবাগদিপাড়ার ঢোলরাতের আকাশরাজপথ
                                 আচার্যর ভদ্রাসন / আচার্যর ভদ্রাসন

  চাঁদ ওঠে এই দেশেএই পুরাকাহিনীর দেশেএকান্তই নিজস্ব ধাঁচের,
     পলিমাটি দিয়ে গড়া চাঁদভিজেআর্দ্র জ্যোৎস্না ঝরে
     সিদ্ধাচার্যের মুখেচকচক করে সেই তৈলাক্ত আনন
     হাজার বছরের কোনো কষ্টিপাথর-কাটা শিল্প বলে মনে হয় ঐ মুখ

     ইচ্ছাবৃক্ষমূলে বসে সিদ্ধাচার্য চর্যাগান গায়
                                           সিদ্ধাচার্য / আচার্যর ভদ্রাসন

     সেই গানের মধ্যে দিয়ে বেজে ওঠে ‘স্খলিত ব্রাত্য এক আচার্যের অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার জেগে ওঠে প্রশ্ন – ‘সংসার কি আরো বড়ো?/ জীবন কি আরো প্রসারিত’, কিন্তু ইচ্ছাবৃক্ষও সব প্রশ্নের উত্তর জানে না – ‘সব সমাধানসূত্র অঙ্কে মেলে নাতাই এই ধ্যানআর তারপর?/ ধ্যানেও মেলে না তবু এক অনলস ‘প্রাকৃতনাস্তিকশূন্য অনুবাদ’ করে চলেন। যেন সেই আত্মক্ষরণে

কোনো ভাষা নেই তাঁরকোনো বাণী নেই
কোনো শোক নেই তাঁরকোনো প্রেম নেই
                                                 ডোম / আচার্যর ভদ্রাসন

     এই আত্মানুসন্ধানের আর্তি ধীরে ধীরে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠল দেবদাসের গহন মর্মলোকে। জ্ঞান ও নির্জ্ঞানের চিরাবৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন যেন আসন্ন হয়ে উঠল। ঘটনাবর্তে এসময় এক মহাগ্রন্থিমোচনের বেদনার অভিঘাত এসে লাগল কবির জীবনে। যার প্রতিক্রিয়ায় রচিত হল তর্পণ (১৯৯৪) এ যেন কোনও মহা-উন্মোচনের পূর্বাভাস। ‘জীবনের অতিরিক্ত যে জীবন’, তার স্পর্শ এসে লাগল এর পৃষ্ঠায়। কবির নির্মোহ শ্রুতিতে বেজে উঠল এক গভীরতার চিরধ্বনি –  

কত পাতা ঝরেসহস্র বছর ধরে ঝরে
বনানীর ভ্রূক্ষেপ নেই
তার আছে অনন্ত মর্মরধ্বনি।
তারও গভীরে যে মর্মর শোনা যায়সেই চিরধ্বনি
পৃথিবী চেনে না।                           নির্মোহ / তর্পণ

     জীবন ও সৃষ্টির অনশ্বরতা কবির মনে এসময় এক অভাবিত নির্বেদ ঘনিয়ে তোলে। তাঁর বিহ্বল দৃষ্টিতে ধরা পড়ে – ‘অপঠিত পুঁথি পড়ে থাকেথাকে অনাবিষ্কৃত ধ্যানঅসম্পূর্ণ মৃদঙ্গ লহরি প্রশ্ন জেগে ওঠেএইসব ‘অসম্পূর্ণ গান এখন কি গাইবে পাখিরা?’ মনে হয়, ‘পৃথিবীও মহাবিশ্বে ক্ষণস্থায়ী ঢেউ’ মাত্র। কবি তাঁর এই শোকানুভূতির নিরাকরণ ঘটিয়েছেনএকদিকে ‘জরা-মৃত্যুহীন একঅন্তহীন গতির বলয়ের অনুধ্যানেঅন্যদিকে ক্ষণস্থায়ী এই প্রাণময়তার গৌরবে উদ্দীপ্ত হয়ে। বিশ্ববিলুপ্তির অন্তিম দিনের জন্য তাই তাঁর শেষ ইচ্ছা – ‘সেদিনের জন্যে এসো জানু পেতে বিশ্বময় প্রাণভিক্ষা চাই।
     কিন্তু চিরমুমুক্ষু চিদাকাশে নির্বেদের কোনও বলয়গ্রাস তো স্থায়ী হতে পারে না। কিছু গভীর মর্মজ্ঞান ও উপলব্ধির স্বাক্ষর রেখে যায় মাত্র। যা হয়তো সৃষ্টি করে আরও অকল্পনীয় কোনও জ্যোতির্বিভাসের। বিশেষত মর্মবিশ্ব আর বিশ্বমর্মের রহস্য অনুধাবনের গূঢ় অতৃপ্তি যে-কবির পিছু ছাড়েনি –

  যুক্তি ও তর্কের ঊর্ধ্বে অদৃশ্য পথ আছে এককেউ কেউ
ঐ পথে বেরিয়েছেমানসভ্রমণেআজও তারা
দীর্ঘ ও লম্বমান পথে হাঁটেঋজুএকরোখা
                                            পথ / নির্বাচিত কবিতা  

  নিজের ভিতরের রহস্যের চেয়ে বেশি আর কি রহস্য আছেজানি না
                                             অহম / নির্বাচিত কবিতা

  আমার শরীর অসংখ্য ছায়াপথে গড়া
     একটা মহাবিশ্বআর –
     আমার আত্মা
     অসংখ্য ছায়াপথের মধ্যে লুকিয়ে থাকা
     কোটি কোটি সৌরমণ্ডলের থেকে ছড়িয়ে পড়া আলো।
                     ওঁ বস্তুএই শরীর ও আত্মা / নির্বাচিত কবিতা

ঐ পাথরের মূর্তি যিনি দীর্ঘকাল আমাদের চিত্তের প্রশাসক ছিলেন
  তাকেও আমি ছুটি দিলাম অন্য কোনো নক্ষত্র খুঁজে নেওয়ার জন্যে

  আজ মনে হয়জনপদের মিশ্রধ্বনিময় এক গান থেকে উঠে আসছি আমি
           জরথুষ্ট্র বলেন / নির্বাচিত কবিতা

     নির্বাচিত কবিতা-য় সংকলিত বিভিন্ন অগ্রন্থিত কবিতার সাক্ষ্য অনুযায়ী জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে-কবি এমন সব উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেনএক নির্বেদ থেকে ক্রমে অন্যতর কোনও সংবেদের দিকে সরে যাবেনসেটাই প্রত্যাশিত।

.
১৯৯৬ সালের শরৎকালে দেবদাস আচার্যর স্বপ্নাবিষ্ট মূর্তিটি কল্পনা করি। অদৃশ্যের অশনিসম্পাতে কোনও অবরুদ্ধ পাহাড়ের গম্ভীর গুহায় যেন কেঁপে উঠল এক আদিষ্ট পুরুষের কণ্ঠ। যুক্তি ও তর্কের উর্ধ্বের অদৃশ্য পথঅসংখ্য ছায়াপথে গড়া শরীরের মহাবিশ্ব ও তার অন্তর্গত রহস্যজনপদের মিশ্রধ্বনিময় গান – যাকিছু পর্বে পর্বে পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল আত্মার গভীরেতা যেন ফেটে বেরিয়ে এল এক ভাস্বর স্রোতের মতোছড়িয়ে পড়ল সুভাষিতম-এর পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। অজস্র ধূমপাথরনুড়িধাতুমলের কুজ্ঝটিকা ভেদ করে উন্মোচিত হল আত্মার অন্তর্বর্তী আলোর সংহতি। সুভাষিতম-কে (১৯৭৭নিঃসন্দেহে আমরা দেবদাসের আর একটি প্রধানতম উদ্ভাস বলে চিহ্নিত করতে পারি।
     ১২৬৩ পঙ্ক্তির এই দীর্ঘ কবিতায় আত্মখননের এক নির্মম প্রক্রিয়ায় কবি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। মননের অনাবিষ্কৃত পরিসর থেকে যেখানে কেবলই নিষ্কাশিত হয় আত্মশুশ্রূষা ও সান্ত্বনাহীনতাপ্রত্যয় ও অসহায়তাউপলব্ধি ও সংশয়ের এক দ্বান্দ্বিক বিস্তার। পাঠসঙ্গী আমাদেরও অসাড় মন থেকে খুলে যায় আবরণের পর আবরণ। খণ্ড অনুভবের প্রেরণাবিন্দুগুলি স্পর্শ করতে করতে আমরাও টের পাই ‘কিছুই স্থান নয়কিছুই ধ্রুবক নয়কিছুই পূর্ণ নয়ভাষা সর্বদা অস্ফুটচিন্তা সর্বদা অস্পষ্টবোধ সর্বদা কুয়াশাছন্ন।’ তবু, ‘জীবন ও মৃত্যু উভয় অভিজ্ঞতায় স্বয়ম্ভরএকটি মমি যখন কথা বলেদ্বিমাত্রিক ভাষায়তখনঅনুভূতির যাত্রা কিছুটা সম্ভব।
     কখনও কখনও এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁকে প্রায় বাগ্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ মনে হয় হয়তোমনে হয় যেন কোনও সুসমাচারের উদ্দীপ্ত প্রচারক তিনি। কিন্তু এ-কাব্যের শীর্ষবন্দুগুলি এমনই আকাশচুম্বী যেসেই অতিকথনগুলিও সানুদেশের তৃণভূমির মতো মনে হয়গোটা রচনাটির মহিমা খর্ব করে না। প্রিয় পাঠিকা-পাঠকআসুনইত্যবসরে কিছু কবিত্বমনীষাদীপ্ত উচ্চারণ চয়ন করি আমরা এহেন সুভাষিতম থেকে –

   নিজের অক্ষমতাকে চমৎকার শিল্পে রূপান্তরিত করার নাম অহং
       অহংকারবোধকে নিরবধি পরিমার্জনা করার নাম জীবন
       বহু জীবনের চলচ্চিত্র ঘিরে অসংখ্য অহংয়ের পরিচর্যার নাম সভ্যতা

   অন্তরাত্মার গ্লানি প্রকাশের জন্যেই স্তব ও বন্দনা
      গ্লানি প্রকাশের ভাষা বিশুদ্ধ হয় না
      স্তব বিশুদ্ধ নয়

   কখনো কখনো দু-একটি রেখার সংঘাতে কিছু উদ্দীপনা তৈরি হয়
      কখনো কখনো দু-একটি রেখার চাঞ্চল্যে কিছু চিন্তা তৈরি হয়
      উদ্দীপনা ও চিন্তার পতাকাগুলি কিছুকাল ওড়ে ও প্রেরণা ছড়ায়
      এক-একটি প্রেরণা কিছুকাল ওড়ে তারপর তাকে নামিয়ে ফেলা হয়

   প্রতিটি বাসনার মধ্যেই প্রবঞ্চনা রয়েছে
      প্রতিটি অনুভূতির মধ্যেই আচ্ছন্নতা রয়েছে
      প্রতিটি জ্ঞানের মধ্যে বদ্ধতা রয়েছে
      প্রতিটি শৌর্যের মধ্যে অন্তঃসারশূন্যতা রয়েছে
      প্রতিটি জয়ের মধ্যে নিঃস্বতা রয়েছে
      প্রতিটি পদক্ষেপে পিছুটান রয়েছে

     অতঃপর আমরা দেবদাস-পরিক্রমার উপান্তে এসে পৌঁছাই। শ্রেষ্ঠ কবিতা-র এই সংকলন শেষ হয়েছে যে আছো অন্তরে (২০০৭আর তারও পরবর্তী কিছু অগ্রন্থিত কবিতা দিয়ে। এই পর্যায়ের কবিতায় ছায়া ফেলেছে জীবন সম্পর্কে এক মোহমুক্ত নিরাসক্তির বোধনির্ভার হয়ে উঠেছে তার প্রকাশভঙ্গিও –

তিন কাল গেছে এভাবেই
হাওয়া মৃদু হেসে বলে
বিষামৃতে জড়ানো সংসারে
কাটো ডুবসাঁতার আর বাকি কটা দিন
এভাবেই শেষ হবে
জীবনের ঋণ।                          কূট / যে আছো অন্তরে

     ইতিমধ্যে হৃৎযন্ত্রের কঠিন পীড়া এসে কবিকে আক্রমণ করে গেছে। সে-আক্রমণ প্রতিহত করে সুস্থতায় ফিরে তাঁর মনে হয়েছে –  আমার জন্যেআরো কয়েকদিনের আলোবরাদ্দ রয়েছেআমি সবার সাথে সে আলোটুকু ভাগ করে নেব এবার হয়তো এই অসুস্থতার কারণেই এক অনভিপ্রেত বয়স্কতার বোধ এসে আচ্ছন্ন করেছে কবিকে। মরজীবনের চূরান্ত উৎকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে – ‘কী চায় মানুষ?/ একটু বিভ্রান্তি এসেছে এতদিনেচুলচেরা বিচারের সাধ্য নেইজয়-পরাজয় নয় প্রজ্ঞা নয় পরমাত্মা নয় তবু শেষ পর্যন্ত প্রাণের বহমানতাই ধ্রুবপদ হয়ে বেজেছে তাঁর বোধে –

         আমিও ক্রমশ অফুরন্তের অংশ হয়ে উঠছি এবং মিশে যাচ্ছি
        মিশে যাচ্ছি      সময়হীনতায়
        মিশে যাচ্ছি নিরন্তরতায় …              নির্বিশেষ / অগ্রন্থিত    
      
         সুর স্বর ধ্বনি শ্বাস ধ্যান সবই
           চির আকুলতার ভিতর ব্যগ্র ও উন্মুখভাবে বহমান
                       অননুমেয় / শ্রেষ্ঠ কবিতা-য় সংকলিত শেষ কবিতা

     এই নশ্বর জীবনও যে এক চির-অফুরন্ত নিরন্তরতার অংশপ্রাণের সকল অভিপ্রায় যে কেবলই পূর্ণতা-অভিলাষী এক আর্তিতে স্পন্দমান – এমনই এক নিবিড়তম অনুভবে দেবদাস আমাদের পৌঁছে দেন।

.
দীর্ঘ পরিক্রমণ শেষে আমাদের প্রতিবেদনপ্রবণ মন বন্ধুর উদ্দেশে একটি ছোট্ট পোস্টকার্ড লিখতে চায়। কবির কবিতার মূল লক্ষণগুলি কীতাঁর বিকাশ ও পরিণতির সঞ্চারপথটিই বা কেমন?
     একখণ্ড বরফ নিয়ে তাপ দিতে থাকলেতা প্রথমে ০০ সেলসিয়াসে জল ও পরে আরও তাপ দিলে ১০০০ সেলসিয়াসে বাষ্প হয়ে যাবে। এ হল একরকমের বিকাশ ও পরিণতি। কিন্তু কেউ যদি বাঘপাহাড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেক্রমে সারা বাংলা পরিক্রমা করে সুন্দরবনে এসে পৌঁছানতবে কি বলা যাবে সুন্দরবন হল কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিণতিকোনওটাই কারও পরিণতি নয়অন্তত বরফ আর বাষ্পের মতো নয়সবটাই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।  
     কবিতাপাঠের অনুভূতিও প্রায় ভ্রমণের অনুরূপ – কেবলই সহৃদয় অনুভবের আহরণ। আরকবিপ্রতিভার বৈচিত্র্য ও বিস্তার পাঠকের অভিজ্ঞতাকেও বহুধা করে। মরু বা মেরু অঞ্চল ভ্রমণে যেমন আমরা দিগন্তদিশারী বিস্তারের স্পর্শ পাইপ্রকৃতির অসীম নগ্নতা আমাদের বিহ্বল করেকিন্তু তাতে বৈচিত্র্যের অবকাশ নেই। তবে স্বভাবের এমন একরূপতা চিহ্নিতকরণের সহায়কযেমন – চিরহরিৎ অঞ্চল বা রোমান্টিক কবি ইত্যাদি। অন্যদিকেবৈচিত্র্যচিহ্নব্যবস্থার তোয়াক্কা করে না। পাহাড়প্রান্তরমালভূমিঅরণ্যসমুদ্র – এই এতকিছুর আয়োজনে যেমন আমাদের দেশবাংলাশুধুই বালি বা বরফে নয়। কবিপ্রতিভার বিচিত্রগামিতার জন্য দেবদাস আচার্যকেও তেমনি আমরা কোনও বাঁধিগতের ছকে ফেলতে পারি না।
     পরিকল্পনা মোতাবেক যেমন জীবন রচিত হয় নাজীবন-তন্নিষ্ঠ দেবদাসও তাঁর কবিতার সঞ্চারপথকে কোনও পরিকল্পিত পরিণতিতে পৌঁছে দিতে চাননি। মৃৎশকট  ও মানুষের মূর্তি-র মতো দ্বিবিধ মৌলিক চরিত্রসম্পন্ন দুটি কাব্যগ্রন্থ ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও রসাস্বাদনের দিকে পাঠককে নিয়ে চলে। প্রতিটির জন্য হয়তো স্বতন্ত্র পরিকল্পনা আছেযেমন তা আছে আচার্যর ভদ্রাসন বা সুভাষিতম-এও। প্রতিটি স্বতন্ত্র সাফল্যকে পর পর অতিবাহন করে এলে যে-অনুভূতি জাগেকবির নিজের ভাষায় তাকে বলা যায় ‘জনপদের মিশ্রধ্বনিময় গান আপাত কর্কশতা ও সচেতন ছন্দবর্জন সত্ত্বেও দেবদাসের অধিকাংশ কবিতায় এক গম্ভীর সংগীতময়তা রয়েছে। যা অবশ্যই মিশ্রধ্বনিময়। তাঁর চিন্তাচেতনার গহনতার মধ্যেই রয়েছে সেই মিশ্রধ্বনির বিস্তার। যা প্রকাশিত হয়েছে রচনারীতির উচ্চাবচতায়কখনও তৎসম শব্দের আঁটোসাটো বিন্যাসেকখনও বা গদ্যস্পন্দের প্রাত্যহিকতার ছোঁয়া-লাগা লৌকিক গড়নে। এবং তা জনপদবাহিতও বটে। বলা বাহুল্যজনপদ বলতে পরাধুনিক মেগাসিটিসমূহ নয়তা আমাদের ঐতিহ্যবাহিত প্রাণকেন্দ্রগুলিযেখান থেকে প্রাকৃতজনেরা নির্বাসিত হননি। কবি যখন নিতান্ত আত্মগত উচ্চারণেও নিমগ্নতখনও সেই প্রাকৃত জনপদ থেকে তাঁর নাড়ির যোগটি ছিন্ন হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবেজীবন তাঁকে যা দিয়েছেতিনি তাঁর বহুগুণ আমাদের হৃদয়ের কবিতাপিপাসু নিভৃত জনপদগুলিতে ফিরিয়ে দিয়েছেন –

        গান করো সব এই মাটির আর এই আকাশের
        গান করো ঐ সূর্যের
        গান করো সব সমুদ্রের আর পাহাড়ের আর
        গাঢ় নিতম্ব শস্যমুখর খামারের
        গান করো সব ইঞ্জিন আর জাহাজের
        গান করো সব শিল্পের



লেখকের সময়পরিধি ছুঁয়ে (প্রকাশক।।ঐহিকবইটি থেকে পুনর্প্রকাশিত